দীর্ঘশ্বাসের জীবন
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ১২:৫৯:১৫ রাত
প্রতিদিন একই রুটিন।
কনার কাছে জীবনটা অসহ্য ঠেকছে। সেই কাকডাকা ভোরে উঠে কল চেপে পানি তোলা। প্রাতঃক্রিয়া সেরে নাস্তা তৈরী করা। মোটে চারটা চুলা। সেখানে ১০ রুমের মানুষ রান্না করে। চুলার দখল পেতে এজন্য এতো ভোরে উঠতে হয়। ছোট দুই রুমের বাসায় ওরা পাঁচজন মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। এক রুম বাবা মা’র জন্য... বাকীটাতে বড় বোন ও তার ছোট দুই মেয়ে এবং সে নিজে। পশুর মত বসবাস এবং বেঁচে থাকাটা এজন্যই অসহ্য লাগে ইদানিং। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকার বসতি গড়ে উঠেছে। লম্বা ‘এল’ শেপের ভাড়া বাসাটার এক অংশ গার্মেন্টসে চাকুরিজীবিদের কাছে ভাড়া দেয়া। এই রুমগুলো ব্যাচেলরদের জন্য। সেগুলো এক রুমের... বাহিরে টয়লেট এবং গোসলখানা। তবে দুই রুমের কথিত ‘ফ্ল্যাটের' ভিতরেই ‘এটাচড বাথরুম-টয়লেট। এরকম ‘ফ্ল্যাট’ রয়েছে ৪টি। আর বাকী ৬টি ব্যাচেলরদের জন্য। সেখানে এক এক রুমে চারজনের বেশী করে থাকছে। গিদার মুন্সীর এরকম আরো দু’টো বাড়ি রয়েছে।
একই প্যাটার্ণের।
এভাবে বানালেই নাকি ভাড়া বেশী উঠে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাসা কখনো খালি থাকে না। গিদার নামের মতোই তার আচরণ ও চলাফেরা। এজন্যই তাকে মানুষ এই নামেই ডাকে। আসল নাম শমসের আলী। তবে ডাকতে ডাকতে এখন ‘গিদার মুন্সী’ই হয়ে গেছে। মুন্সী ওদের কোনো পারিবারিক উপাধি নয় কিংবা সে যে খুব পরহেজগার তাও নয়। মাথায় সবসময় একটা টুপি থাকে। এজন্য মুন্সী উপাধি। আর নোংরা থাকার কারণে ‘গিদার’ নামকরণ। ওনার নামের মতোই কনাদের ভাড়া বাসাটার পরিবেশ ও নোংরা। মেইন রাস্তা থেকে অনেকটা নিচুতে হওয়াতে কিছুটা জায়গা সারা বছরই প্যাকে ভর্তি থাকে। আর অধিবাসিদের পালিত হাঁস-মুরগীর মলে পুতি-দুর্গন্ধময় পুরো এলাকাটা।
ব্যাংকের জানালা দিয়ে মোড়ের চা এর দোকানের দিকে তাকিয়ে আনমনে এসব ভাবছিল কনা। সেখানে কয়েকজন যুবক আড্ডা দিচ্ছে। ওদের সবাইকে না চিনলেও একজনকে বেশ ভালোভাবেই চিনে সে। বছরখানিক হল সে কণাকে দূর থেকে দেখে শুধু। বাসা থেকে অফিসে যাওয়া-আসার পথে ওর পিছু নিলেও আজ পর্যন্ত কখনো খারাপ-ভালো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পুরুষ মানুষের চোখের দৃষ্টি কনা ভালোই চিনে... বোঝে। বাবুল নামের ছেলেটির দৃষ্টিতে ওর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা সে দেখতে পেলেও নিজে থেকে কিছু বলে না... সাড়া দেয় না। ছেলেটি একবার বেনামে একটি চিঠি দিয়েছিল। সেটা আজও সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। তবে আজকাল কেউ কাউকে চিঠি দেয় না। এজন্যই বেশ অবাক হয়েছিল। এখন তো ফেসবুকে ইনবক্সে রোমান্স চলে... না হলে মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা অলস প্রেমালাপ। এদিক দিয়ে বাবুল অনেক ব্যাকডেটেড।
এই নিয়ে আজ দু’বার বাবুলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। এভাবেই কাটছে সময়।
একজন নীরব প্রেমিকের এই উৎকন্ঠাটুকু কেন জানি আজকাল, কনার অসহ্যকর জীবনের ক্ষণগুলোতে একটু হলেও আনন্দ দিয়ে যায়। তবে মেয়ে বলে সে উপযাজক হয়ে তো আর বলতে পারে না যে ‘ তোমায় ভালোবাসি’।
এছাড়াও ওর আরো সমস্যা রয়েছে। বাসায় অসুস্থ মা... ডিভোর্সী বোন... অক্ষম বাবা। এতোগুলো মানুষের জন্য খাবারের জোগাড় করতে হয় ওকে। বড় বোন অবশ্য বাসায় বসে কিছু সেলাইয়ের কাজ করে। আশেপাশের মহিলারা অর্ডার দেয়। যা আয় হয় তাতে করে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে সে ও কিছুটা অবদান রাখে। তবে সেটা একেবারে অকিঞ্চিত।
এই অবস্থায় কীভাবে কনা কাউকে বলে, ‘চলো, ঘর বাঁধি!’
আর যাকে বলবে সে ও তো কিছুই করে না।
শুধু ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবন চলে না...
আর ও চলে গেলে বাবা মা- বোন আর তার দুটি বাচ্চাকে কে দেখবে?
একটু হাসির ভঙ্গী করে কণা। দীর্ঘশ্বাসের জীবনে এই জিনিসটারই বড্ড অভাব। তারপরও কণা নামের বিত্তহীন পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো হাসতে চেষ্টা করে।
হাসি হৃদয় থেকে আসে কি?
বিষয়: সাহিত্য
৯৭৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা পুরা জাতিই এখন ক্রিতদাস।
ভালো থাকুন, শুভরাত্রি।
আর্টিফিশিয়াল সুখি হওয়ার মাঝে আজকাল কোনটা রিয়েল আর কোনটা আর্টিফিশিয়াল তা বুঝাই মুসকিল।
ধন্যবাদ আপনাকে।
সুন্দর অনুভূতির জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
ভালো থাকুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন